১৬২ দিনের মাথায় বিচার পেল তিলোত্তমা।আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়।আগামী সোমবার সাজা ঘোষণা করবে আদালত।যদিও এদিন রায় শুনেই আদালতের মধ্যে চিৎকার শুরু করেন সঞ্জয়।বিচারককে সঞ্জয় বলেন তিনি নির্দোষ।তাকে ফাঁসানো হয়েছে।এখানেই না থেমে সঞ্জয় চিৎকার করে বলে ‘আমি কিছু করিনি।যারা করেছে তাদের কেন ছাড়া হল?আমার কোনও দোষ নেই।সবাই মিলেই করেছে।আমি পাপ করিনি।আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।আমার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আছে।রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে যদি এই অপরাধ করতাম তাহলে রুদ্রাক্ষের মালা ছিঁড়ে পড়ে যেত।স্যার আপনি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই আমাকে পুরো ফাঁসানো হয়েছে।’এরপরই পুলিশের এক কর্তার দিকে সে আঙ্গুল তোলে।বিচারক অনির্বান দাস জানিয়ে দেন,-‘সাক্ষীদের জেরা করে এবং সিবিআই যে সমস্ত নথি ও তথ্য আদালতে জমা দিয়েছে তা বিচার বিশ্লেষণ করেই আপনাকে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ (ধর্ষণ), ৬৬ (ধর্ষণের পর মৃত্যু) এবং ১০৩ (১) (খুন) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে। আগামী সোমবার শাস্তি ঘোষণা।তার আগে আপনার বক্তব্য ওদিন শুনবো।’এরপরও স্যার, স্যার বলে আদালতে চিৎকার করে সঞ্জয় বলে ওঠেন,-‘আপনি তো দোষী সাব্যস্ত করেই দিলেন।আমি গরিব।আমি এই কাজ করিনি।’সঞ্জয়ের আইনজীবীও মক্কেলকে শান্ত হতে অনুরোধ করেন।কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় আদালত চত্বর থেকে জোর করেই পুলিস ভ্যানে তোলা হয় সঞ্জয়কে।বিচারকের রায় শুনে কান্না আটকাতে পারেন নি আরজি করে নির্যাতিতার মা,বাবা।বিচারককে ধন্যবাদ জানান তাঁরা।তাদেরও বক্তব্য সোমবার শোনা হবে বলে জানান শিয়ালদা আদালতের বিচারক অনির্বান দাস।

প্রসঙ্গত,গত বছরের ৯ অগাস্ট আরজি কর হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পর দিনই সঞ্জয়কে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিস।তার দিন সাতেকের মধ্যেই প্রবল আন্দোলনের চাপে পড়ে ঘটনার তদন্তভার সিবিআইএর হাতে তুলে দেয় রাজ্য।দীর্ঘ তদন্তের পর সিবিআই সঞ্জয়কেই একমাত্র দোষী সাব্যস্ত করে আদালতে চার্জশিট পেশ করে।সেই মামলারই ১৬২ দিন পর শনিবার মাত্র ১২ মিনিটে রায় ঘোষণা করলেন বিচারক।আগামী সোমবার সাজা ঘোষণা।এদিন সঞ্জয় রায়ের দাবি ঘিরে একাধিক প্রশ্ন উঠেছে।এর আগেও জনমানসে এবং সমাজ মাধ্যমে সঞ্জয় একাই দুঃষ্কর্ম করেছিল কিনা তা নিয়ে তীব্র সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল।আইনজীবীদের একাংশের ধারণা সেটা কে কাজে লাগিয়েই বেনিফিট অফ দাউট নিতে চাইছে সঞ্জয়।সিবিআইএর তদন্তকারী থেকে আদালত, এর আগে এব্যাপারে নির্দিষ্ট কারোর বিরুদ্ধে কখনো মুখ খোলেনি সঞ্জয়।সেটা কি ভয় না বাঁচিয়ে দেবার আশ্বাসে,এবং শনিবার ‘সবাই’ বলতে সে কাদের বোঝালো,প্রশ্নগুলোর উত্তর যেনো অধরা থেকেই যাচ্ছে।এখন দেখার বিষয় আগামী সোমবার আরজি করে তরুণী চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের মামলায় কোন সাজা উঠে আসে।মূলত,সেই দিকেই মুখিয়ে গোটা দেশ।

উল্লেখ্য,আরজি কর কান্ডে শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠেছিল কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে।বিতর্কের মধ্যেই সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার দিয়ে দেয় কলকাতা হাইকোর্ট।যদিও শেষ পর্যন্ত সেই কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া সঞ্জয়কেই মূল অভিযুক্ত হিসাবে দেখায় সিবিআই-ও।আর শনিবার শিয়ালদহ কোর্টে আরজি কর কাণ্ডে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরই গর্জে ওঠেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ।কলকাতা পুলিশের ভূয়সী প্রশংসা করে কুণাল বলেন,-“ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় কলকাতা পুলিশ যাকে গ্রেফতার করেছিল।তদন্তের অভিমুখ ঠিক ছিল।আজ সেটা আবার প্রমাণিত হল।কেউ কেউ রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছিলেন।সিবিআই তদন্তে কলকাতা পুলিশের তদন্ত মান্যতা পেল।আজকের রায় প্রমাণ করল কলকাতা পুলিশ ঠিক।মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন মৃত্যুদণ্ড হবে।”বিরোধীদের খোঁচা দিয়ে কুণাল ঘোষ বলেন,-“বিরোধীরা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নানা কথা বলে চলেছেন।আমরা গোড়া থেকে ঘটনার নিন্দা করেছি।ক্যারিয়ার, ব্যক্তিগত ব্যাপার,রাজনৈতিক অ্যজেন্ডা করে আমাদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে।মুখ্যমন্ত্রী সদিচ্ছা নিয়ে যথাযথ তদন্ত শুরু করেছিলেন।কুৎসা আর মিথ্যা যারা বলেছেন,তারা আজ বুঝতে পারছেন।”এরপরই দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে কুণাল আরো বলেন,-“আমরা ফাঁসি চাই।আর জি করের পরেও যে ঘটনা ঘটেছে তাতেও আমরা ফাঁসি চেয়েছি।সেখানেও ফাঁসি চাই।”

যদিও এখানে খোঁচা দিতে ছাড়েনি বিজেপি।বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার বলেন,-“প্রথম থেকেই বলেছি ৫ দিন কলকাতা পুলিশের হাতে তদন্তভার ছিল সেই সময় কী কী তথ্য-প্রমাণ কোথায় গিয়েছে তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে।ফলে আপাতত সঞ্জয় রায় ধরা পড়েছে।কিন্তু সঠিক তথ্য-প্রমাণ হাতে থাকলে কী হত সেটা বোঝা যেত।কিন্তু,এই মুহূর্তে তো সেই পরিস্থিতি নেই। তবে সঞ্জয় যদি দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে ওর সর্বোচ্চ সাজা হোক আমরা চাইব।”কার্যত সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার যাওয়ার আগে তথ্য প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে বলে আগেই বিজেপি নেতৃত্ব বার বারই দাবি করেছিলেন।এদিন রায় ঘোষণার পরে ফের সেই একই দাবি তুলে দিলেন তাঁরা।এই প্রসঙ্গে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন,-আমরা আরও খুশি হতাম যদি সন্দীপ ঘোষ ও বিনীত গোয়েলকে অভিযুক্ত হিসাবে ঘোষণা করা হত।

শনিবার আদালতের রায়ের পর ক্ষোভ প্রকাশ করলেন জুনিয়র চিকিৎসকদের একাংশ।অনিকেত মাহাতো সাংবাদিকদের জানান,-‘এই রায়ে একদমই খুশি নই।প্রথম থেকে বলে আসছি এই ঘটনার সাথে দোষী একজন নয় একাধিক জন জড়িত।শুধু আমরা বলছি না বিভিন্ন আইনজীবীরাও এই কথা বলছেন।একাধিক ব্যক্তি জড়িত কিন্তু শাস্তি পাচ্ছে একজন!এ কেমন বিচার?বাকিরা মুক্ত কেন?প্রকাশ্য দিবালোকে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।সিবিআই তদন্ত করছে।তারপরেও বাকিদের ধরা হচ্ছে না কেন?’আরেক জুনিয়র চিকিৎসক জানান,-আমরা প্রথম দিন থেকেই বলেছি বিচারের জন্য যতদূর যেতে হয় যাব।রাজপথ ছাড়ব না আমরা।লড়াই আমাদের চলবে।আগামী দিনে কীভাবে আমাদের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাব তা নিয়ে আলোচনা করব।সঞ্জয় রায় দোষী হলে অবশ্যই শাস্তি হোক।কিন্তু একজনের পক্ষে সেমিনার রুমে গিয়ে এই ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *