ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে ১৯৪২ সাল বিশেষভাবে স্মরণীয়। ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ ‘থানা দখল’ সহ বিভিন্ন গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনা ঘটে চলেছে এই সময়। পরবর্তী কালে যা ইংরেজ সরকারকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছিল।
১৯৪২ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে স্ব-শাসিত সরকার। যেমন মহারাষ্ট্রের সাতারা জাতীয় সরকার, উড়িষ্যার জাতীয় সরকার, উত্তর প্রদেশের বালিয়ার জাতীয় সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার।
ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল গুলোতে জাতীয় সরকারের স্থায়িত্ব বেশি দিন না হলেও পশ্চিমবঙ্গের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের স্থায়িত্ব প্রায় ২২ মাস স্থায়ী ছিল ।
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অবিস্মরনীয় ঘটনা তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার যা নিয়ে আজও মেদিনীপুর গর্ব করে। এই জাতীয় সরকারের মূল কান্ডারী ছিলেন সতীশ চন্দ্র সামন্ত, অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় ও সুশিল কুমার ধাড়া ওনাদের একত্রে তাম্রলিপ্তের ত্রয়ী বিপ্লবী বলা হত।
এই ত্রয়ী নেতার নেতৃত্বে ১৯৪২ সালের ১৭ ডিসেম্বর তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠন করে মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্ন সফল করলেন। ক্ষুদ্র আঞ্চলিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এই কাজ মহান বীরত্বের দাবি রাখেন ।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের জন্ম লগ্ন বড়ই দুঃখের ও দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল ১৯৪২ সালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আগস্ট বিপ্লব শুরু হয়েছিল। ইংরেজরা গ্রামের পর গ্রাম ঘেরাও করে ব্যাপক লুণ্ঠন, অমানুষিক অত্যাচার, সাধারণ মানুষের বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ, এমনকি নারী ধর্ষণের মত বর্বরোচিত ঘটনা চালায়ে ছিল।
সেই সময় মহিষাদলের দনিপুর বাজারে চালকলে ইংরেজের গুলিতে ৩ জন শহীদ হন, ২৯ শে সেপ্টেম্বর মহিষাদল ও তমলুক থানা দখলকে কেন্দ্র করে গণ অভ্যুত্থান, ৭৩ বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরার সহ ১৩ জনের শহীদ হওয়া, কিশোর পুরিমাধব, আশুতোষ, গৌরীহরি কামিলা,শেখ আলাউদ্দিন, জীবন বেরা ও ব্রজ গোপাল দাস সহ ৪৩ জন শহীদ হওয়ার ঘটনা ঘটল ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই ঐ সময় গড়ে উঠলো বিদ্যুৎ বাহিনী ও ভগিনী সেনা বাহিনী।
একদিকে পুলিশের ব্যাপক অত্যাচার অন্যদিকে অক্টোবর মাসেই প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আর বন্যা সমগ্র মহকুমাকে তছনছ করে দিলো। প্রবল ঝড় – জলোচ্ছ্বাস বন্যায় গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়। ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি সত্ত্বেও ইংরেজ সরকার কোন রকম সহযোগিতা করেনি। বরং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি যারা ঐ সময় মানুষের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের কাজকর্মেও বাধা দেয় ইংরেজরা।
এই অরাজকর পরিস্থিতিতে ইংরেজদের অত্যাচারের উৎপীড়নের অবসান ঘটিয়ে শাস্তি প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় প্রমোদ গুনছে মাহকুমার মানুষরা। ঠিক এই রকম রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যেই ১৭ই ডিসেম্বর গড়ে উঠলো সমান্তরালে একটি জাতীয় সরকার – ‘মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ এই সরকার ২১ মাসের কিছু সময় বেশি প্রায় ২২ মাস স্থায়িত্ব ছিল। এই সরকারের নিজস্ব মন্ত্রীসভা, বিভিন্ন বিভাগীয় মন্ত্রী, জাতীয় বাহিনী, আদালত, কারাগার, সর্বোপরি সর্বাধিনায়ক আর তার বিস্ময়কর মৃত্যু বাহিনী – যার নাম ‘গবমদল ’ ছিল।
ইংরেজ শাসনকালে এটি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমান্তরাল জাতীয় সরকার। এই সরকারের সর্বাধিনায়ক হন বিপ্লবী সতীশ চন্দ্র সামন্ত। এই সরকারের বিভিন্ন বাহিনী গঠিত হয়। এই জাতীয় সরকার সে সময় পৃথক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। আইন-শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিচার, কৃষি, প্রচার, সমর ইত্যাদির পৃথক পৃথক ভাগ করে প্রতিটি ভাগে এক একজন সচিব নিয়োগ করা হয়েছিল।
সবার উপরে ছিলেন সর্বাধিনায়ক বিপ্লবী সতীশ চন্দ্র সামন্ত। অর্থসচিব ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় এবং সমর ও স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন সুশীল কুমার ধাড়া।
১৯৪৩ সালের জুন মাসে গ্রেফতার বরণের আগে পর্যন্ত সতীশ চন্দ্র সামন্ত এই সরকার পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সফলভাবে কাজ করেছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণকার্যও চালায় এই জাতীয় সরকার।
তখন এই তাম্রলিপ্ত এলাকার অনেক জাতীয়তাবাদী ধনী ব্যক্তি এই জাতীয় সরকারের বৈপ্লবিক কাজ কর্মের জন্য অর্থদিয়ে, ত্রাণের জিনিস পত্র দিয়ে সাহাহ্য করে ছিলেন। সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে গ্রামের জমিদার সকলেই সাধ্যমত অর্থ জুগিয়ে ছিলেন।
এই সরকারের ‘বিপ্লবী’ নামে একটি মুখপত্র বা বুলেটিন বের হত। সর্বমোট ৮৩ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৪৪ সালে ১ লা সেপ্টেম্বর এই সরকারের পরিসমাপ্তি ঘটলেও ৩০ শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অস্তিত্ব।
মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের আজ ৮০ বছর পূর্তি হল।
স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং অগ্নিযুগের বীর বিপ্লবী শহীদ রাজেন্দ্র নাথ লাহিড়ী আমরা রাজেন্দ্র লাহিড়ী নামেই চিনি। ইংরেজ শাসনকে ভারত থেকে উৎখাত করবার জন্য কিশোর বয়স থেকেই বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনেকটা ত্বরান্বিত করেছিল।
১৯২৫ সালের ৯ ই আগস্ট লখনৌ থেকে ১৪ মাইল দূরে কাকোরি ও আলমনগর স্টেশনের মাঝে একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনকে চেন টেনে থামিয়ে সরকারী কোষাগারের টাকাসহ সিন্দুক সরানো হয় সেই কাণ্ডের সাথে যে ১৬ জন বিপ্লবী অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে বিপ্লবী রাজেন্দ্র লাহিড়ী অন্যতম ছিলেন। তাঁদের এই বীরত্বপূর্ণ কাজ স্বাধীনতার ইতিহাসে কাকোরি বিপ্লব নামে পরিচিত হয়ে আছে ।
জন্ম: ২৩ শে জুন ১৯০১ সাল, মোহনপুর, পাবনা জেলা বাংলাদেশ ।
আত্মবলিদান : ১৭ ই ডিসেম্বর, ১৯২৭ সাল, গোন্ডা জেলার জেলখানা, উত্তর প্রদেশ ।
রাজেন্দ্র লাহিড়ী পাবনা জেলার মোহনপুরে এক ব্রাম্ভন পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম ক্ষিতীশমোহন লাহিড়ী আর মায়ের নাম বসন্তকুমারী দেবী। তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকেই স্বদেশপ্রেমে দীক্ষা পান। উচ্চশিক্ষার জন্য বেনারসে আসেন সেখানে বেনারস হিন্দু বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
বারাণসীর ক্লাব, জিম্নাসিয়াম ও সাহিত্য বিষয়ক সমস্ত কিছুর সাথে তাঁর নিবীড় যোগাযোগ তৈরী হয়েছিল। তিনি খুব অল্পসাময়ের মধ্যে সকলের খুব প্ৰিয় হয়ে উঠেছিলেন। রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক হলেন । এখানে পড়াশুনা করতে করতেই তিনি উত্তরপ্রদেশের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন।
রাজেন্দ্র লাহিড়ী, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল এবং যোগেশ চ্যাটার্জী তিনজন মিলে ‘ ইউনাইটেড অল ইন্ডিয়া রেভোলিউশনারি ’ পার্টি গঠন করেন। পরে এই দল ‘ বেঙ্গল অনুশীলন সমিতি ’র সাথে যুক্ত হয়ে ‘ হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন ’ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই দল পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন রাজেন্দ্র নাথ এবং তাঁর দলের অন্যান্য সদস্যরা মিলে ৯ আগস্ট ১৯২৫ সালে কাকোড়ী স্টেশনের কাছে ট্রেন থেকে সরকারী সম্পদ লুট করেন।
লুণ্ঠিত সম্পদ দিয়ে তাঁরা অস্ত্রাদি কেনার কাজে ব্যয় করেন। এমনকি বোমা বানানোর প্রণালী শেখার জন্য রাজেন্দ্রনাথ বোমা বানানোর কারখানায় কাজ করাও শুরু করেছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের বোমার কারখানাতে গিয়েই তিনি সংবাদপত্রে কাকোরি বিপ্লব সংক্রান্ত গ্রেপ্তারসমূহের সংবাদ পাঠ করেছিলেন। এদিকে বেনারসে তাঁর বাড়ি তল্লাশি করা হয়েছিল এবং তাঁর গ্রেপ্তারের আদেশপত্র বের হয়েছিল।